শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

ভিক্ষুক বৃদ্ধার জরাজীর্ণ ঘরে বিদ্যুৎ দপ্তরের আধিকারিকের সহৃদয়তায় পৌঁছাল আলো! প্রশংসায় এলাকাবাসী

আত্রেয়ী সেন | তনুজ জৈন

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২, ০৭:০৪ পিএম | আপডেট: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২২, ০১:০৪ এএম

ভিক্ষুক বৃদ্ধার জরাজীর্ণ ঘরে বিদ্যুৎ দপ্তরের আধিকারিকের সহৃদয়তায় পৌঁছাল আলো! প্রশংসায় এলাকাবাসী
ভিক্ষুক বৃদ্ধার জরাজীর্ণ ঘরে বিদ্যুৎ দপ্তরের আধিকারিকের সহৃদয়তায় পৌঁছাল আলো! প্রশংসায় এলাকাবাসী

নিজস্ব প্রতিনিধি, মালদহঃ বছর ৯০-এর বৃদ্ধা। স্বামী গত হয়েছেন, তাও তিরিশ বছর আগে। ভিক্ষাবৃত্তি করেই দিন গুজরান হয় বৃদ্ধার। সক্ষম দুই ছেলে থাকলেও, তাঁরা কেউই বৃদ্ধা মায়ের দায়িত্ব নেয়নি। দুই ছেলের পাশাপাশি মেয়েও হয়েছে বৃদ্ধার। মেয়েদেরও বিয়ে হয়ে গেছে। এক মেয়ে মাকে দেখলেও, তাঁর আবার তেমন আর্থিক সামর্থ্য নেই। ফলে এই বৃদ্ধ বয়সে এসেও, ভিক্ষা করে দিন গুজরান করতে হয় হয়। বাড়ি-ঘরের অবস্থাও জড়াজীর্ণ। বিদ্যুৎ নেই বাড়িতে। কোনওরকমে আধপেটা খেয়ে, গরমে কষ্টের মধ্যে অন্ধকারে দিন কাটাতে হতো বৃদ্ধাকে।

বৃদ্ধার এই অবস্থা দেখে, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন বিদ্যুৎ দপ্তরের আধিকারিক। মানবিক রূপ সামনে এল বিদ্যুৎ দফতরের আধিকারিকের। সম্পূর্ণ বিনামূল্যে বাড়িতে মিটার বসানো হল এবং যতদিন বৃদ্ধা বেঁচে থাকবেন ততদিন তাঁর বিদ্যুতের বিল লাগবে না। এমনটাই জানা গিয়েছে। বিদ্যুৎ দপ্তরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ এলাকাবাসী।

মালদহের হরিশ্চন্দ্রপুর থানা এলাকার অন্তর্গত দক্ষিণ রামপুর গ্রামের বেদ পাড়ার বাসিন্দা গুসরি বেদ। স্বামী মারা গেছেন প্রায় ৩০ বছর আগে। তার দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে রয়েছে। ছেলেদের নাম হল কৈলাস বেদ এবং ভক্ত প্রহ্লাদ বেদ। মেয়েদের নাম নয়না বেদ এবং শোভা বেদ। দুই ছেলের কেউই মায়ের দেখাশোনা করে না। দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে কাটিহারে এবং আরেক মেয়ে শোভা বেদের বিয়ে হয়েছে বেদ পাড়াতেই। সেই মেয়েই একমাত্র মায়ের দেখভাল করে। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। তাই ৯০ বছর বয়সেও বৃদ্ধা গুসরি বেদকে ভিক্ষা করে দিনযাপন করতে হয়।

গুসরি বেদের স্বামী মধু সংগ্রহের কাজ করতেন। কিন্তু স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকেই অবস্থা খারাপ হয়। আগেই যে আর্থিক অবস্থা খুব ভাল ছিল তা নয়। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর, গুসরির জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। ভিক্ষা করতে হয়। এই বয়সেও তাঁকে ট্রেনে বাসে ভিক্ষা করে বেড়াতে হয় শুধুমাত্র নিজের পেটের খাবার জোটানোর জন্য। কোনো সরকারি ভাতা গুসরি বেদ পান না। তাঁর জরাজীর্ণ ঘরে বিদ্যুৎ পর্যন্ত ছিল না। ফলে আধপেটা খেয়ে নব্বই বছরের বৃদ্ধাকে ভগ্ন ঘরে অন্ধকার আর গরমের মধ্যেই দিন কাটাতে হচ্ছিল।

এভাবেই চলছিল দিন। ভিক্ষা করতে করতে তিনি একদিন যান হরিশ্চন্দ্রপুরে বিদ্যুৎ দপ্তরের অফিসে। সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ দপ্তরের আধিকারিক প্রদীপ কুমার দাসকে কথায় কথায় নিজের দুর্দশার কথা বলেন গুসরি বেদ। ৯০ বছরের এক বৃদ্ধার এরকম অবস্থা দেখে, সহানুভূতি হয় বিদ্যুৎ দপ্তরের আধিকারিক প্রদীপ কুমার দাসের। তিনি নিজে ওনার বাড়ি যান পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য। সেখানে গিয়ে তিনি বুঝতে পারেন, ওই বৃদ্ধার প্রতিটি কথাই সত্যি। গুসরি বেদ প্রচন্ড কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করছেন।

তারপরেই তিনি নিজে দায়িত্ব নিয়ে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তাঁর বাড়িতে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে দেন। সঙ্গে আলো এবং পাখার ব্যবস্থাও করে দেন। বিদ্যুৎ দপ্তর সূত্রেও আরও বলা হয়েছে যে, যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন, ততদিন বিদ্যুৎ বিল দিতে লাগবে না। বিনামূল্যে বিদ্যুৎ পেয়ে স্বভাবতই খুশি ৯০ বছরের বৃদ্ধা গুসরি বেদ।

অন্যদিকে, কোনও সরকারি ভাতা না পাওয়ার জন্য, তিনি কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য এবং পঞ্চায়েতের প্রধানকে। সরকারি সাহায্য বলতে তিনি শুধুমাত্র এখনো পর্যন্ত আবাস যোজনার ঘর পেয়েছেন। সেই ঘরের কাজ সামান্য কিছুটা হয়েছে। তবে, বিদ্যুৎ দপ্তরের আধিকারিকের এই মানবিক রূপের প্রশংসা করেছে এলাকাবাসী। জন-প্রতিনিধিরা যেখানে নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন, সেখানে তাঁর এই কাজ প্রশংসা কুড়িয়েছে সকলের।

বৃদ্ধা গুসরি বেদ বলেন, ‘আজ আমার বাড়িতে এসে মিটার লাগিয়ে গেলো। কোন রকম টাকাপয়সা লাগেনি। আমার দুই ছেলে আছে তারা কেউ দেখে না আমাকে। এক মেয়ের বিয়ে এই পাড়াতেই হয়েছে তাকে তার স্বামী ছেড়ে দিয়েছে সে আমার কাছে থাকে। আমি পঞ্চায়েত সদস্য এবং প্রধানকে বলার পরেও কোন রকম ভাতা পাইনি। ভিক্ষা করেই দিন কাটে।’

হরিশ্চন্দ্রপুর বিদ্যুৎ সরবরাহ অফিসের টেকনিশিয়ান শেন্টু দাস বলেন, ‘আজ আমরা এসে মিটার লাগিয়ে গেলাম। সঙ্গে ফ্যান এবং আলোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। আমাদের এসএস প্রদীপ কুমার দাস আমাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাই আমরা এসেছি। এসে দেখলাম সত্যিই ওই বৃদ্ধাকে প্রচন্ড কষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাতে হয়। উনি আমাদের ভাতার কথা বলছিলেন, কিন্তু সেটা তো আমাদের দায়িত্ব নয়। সরকারি সাহায্য উনি পেলে খুব ভালো হতো।’

৯০ বছর বয়সের ভারে শরীর ভেঙে পড়েছে। পর্যাপ্ত খাদ্যও জোটে না। তবুও বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকতে গুসরি বেদকে ভিক্ষা করে যেতে হচ্ছে কখনও ট্রেনে, কখনও বাসে, এখানে-ওখানে। এই ধরনের অসহায় এক বৃদ্ধার কাছে যদি সরকারি প্রকল্পের সাহায্য না পৌঁছানো নিঃসন্দেহ অত্যন্ত দুঃখজনক।