তৎকালীন বাঙালি সমাজে বেহারা বা বাহকরা ছিল মূলত দুলে ও বাগদি সম্প্রদায়গ্রস্ত। গ্রামবাংলার এই পালকিবাহকদের জন্য ধনী ও জমিদাররাই গড়ে দিয়েছিলেন বসবাসের স্থান। তাঁরা শুধুমাত্র পালকিবাহকের কাজই করত না, জমিদারবাবুদের লেঠেলবাহিনী হিসেবেও কাজ করে দিত। যত দূর জানা যায়, এই দুলে ও বাগদি শ্রেণির বাহকদের সরিয়ে রাজা নবকৃষ্ণ প্রথম ওড়িয়া পালকি-বেহারাদের কলকাতা শহরে নিয়ে আসেন। কারণ দুলে-বাগদিরা নাকি অচ্ছুত। তিনি এই ওড়িয়া বাহকদের মদত দেওয়ায় তাঁরা ক্রমশই কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ে।
১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দের দিকে `পাঁচজন ঠিকা বেহারার একদিনের ভাড়া ছিল এক টাকা। আর অর্ধদিবসের জন্য আট আনা। কলকাতার বাইরে পাঁচ মাইল পর্যন্ত যেতে পালকি ভাড়া হতো চার আনা হিসেবে। এক ঘণ্টার কম সময়ের জন্য যাত্রীরা এক আনা হিসেবে ভাড়া দিত। ফলে এই ভাড়া সবার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হতো না। ফলে পালকিতে চড়ার অধিকার কেবল বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
বেহারারা রীতিমতো যাত্রীদের সঙ্গে দরদাম কষে লাভের হিসাব বুঝে নিয়েই পালকি বইতো। আর এই বিষয়টাই ইংরেজদের ভালো লাগেনি। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয়, পালকিবাহকদের ক্ষেত্রেও দর দামটা বাঁধা হবে। আইন তৈরি করে জানানো হলো যে, প্রত্যেক বেহারাকে পুলিশের খাতায় নাম লেখাতে হবে আর মজুরি নিতে হবে ঘণ্টানুযায়ী। প্রত্যেক বেহারাকে পরতে হবে সংখ্যা জ্ঞাপক চাকতি। আইনের অন্য বিষয় মানায় বেহারাদের আপত্তি ছিল না। কিন্তু নতুন নিয়মে মজুরি কমে যাওয়ায় শুরু হলো শুরু হলো আন্দোলন। পালকিবাহকদের ধর্মঘট। বাহকদের বড় অংশ একত্রে জড়ো হয়ে সভা ডাকল। সেই সভায় পালকিবাহক পাঁচু সুর ছিলেন সভাপতি, আর প্রধান বক্তা ছিলেন গঙ্গাহরি।
বেহারাগণ ইংরেজ সরকারকে লিখিতভাবে জানালো, কিন্তু কোনও ফল হলো না। ইংরেজরা তাঁদের আবেদন উপেক্ষা করে নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল। ফলে কয়েক হাজার বেহারা রাস্তায় নেমে এলো, মিছিল নিয়ে তাঁরা লাল বাজারের পুলিশের প্রধান কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ দেখালো। বিক্ষোভ হলো সুপ্রিম কোর্টের সামনেও। সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে এলো এই ঘটনা।
পালকিবাহকের ধর্মঘট প্রায় ১ মাস স্থায়ী হয়েছিল। এই ধর্মঘট ইংরেজ প্রশাসন ও অভিজাত লোকেরা বেশ বিপাকে পড়েছিল। অবশেষে পালকিবাহকদের দাবির কাছে ইংরেজ সরকার নমনীয় হতে বাধ্য হয়।
এদিকে পালকির অভাবে তিনদিন ধরে বাড়িতে বসে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন ব্রাউন সাহেব। ডাকলেন মিস্ত্রী। পাল্কির হাতল খুলিয়ে তলায় দুটো চাকা লাগিয়ে দেওয়া হল এবং সামনে জুড়ে দেওয়া হল ঘোড়া। অতঃপর কলকাতার রাস্তায় চালু হলো ঘোড়ার গাড়ি। আমজনতা এর নাম দিল “পালকি গাড়ি” , সাহেবরা স্রষ্টার নামানুসারে এর নাম দিলেন ‘ব্রাউনবেরি’ গাড়ি। আর এভাবেই ধর্মতলার মোড়ে শুরু হওয়া প্রথম ধর্মঘট শহরকে না থমকে করে দিল আরও গতিশীল।
আপনার মতামত লিখুন :