ভাত খাওয়ার পরে চুন, খয়ের দিয়ে এক খিলি পান মুখে পড়লে মন্দ হয় না বৈকি! বাঙালির সঙ্গে পানের সম্পর্ক আজকের নয়। দিদিমা ঠাকুমাদের কাছে পানের বাটা আজও মেলে! আর বাঙালির ঐতিহ্যবাহী সেই পানের সঙ্গে আজও তাল মিলিয়ে চলছে কল্পতরু পান সেন্টার। এই ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়েছিল সাবেক পূর্ববঙ্গে। দেশভাগ হওয়ার পরে কলকাতায় এসে পানের সেই ব্যবসা হয়ে উঠল কল্পতরু ভান্ডার৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী থেকে রাধাকৃষ্ণন, মহানায়ক উত্তমকুমার থেকে মান্না দে, বহু গুণীজন এই দোকানের পান খেয়েছেন।
পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা পর্যন্ত পান পাওয়া যায় এই দোকানে৷ ৯২ বছর বয়সি এই দোকানটির বর্তমান কর্ণধার শ্যামল দত্ত৷ ১০০০ টাকার পান! বলেন কী! ৫ টাকা দামের ‘মুখরঞ্জন’, ১১ টাকার মুখ বিলাস বা ১০১ টাকা দামের ‘বেনারস রুচি’ থাকলেও ক্রেতার নজর কাড়ে ১০০১ টাকা দামের পান ‘কল্পতরু স্পেশ্যাল’। একটা পানের এত দাম শুনলে আঁতকে উঠতে হয় বৈকি! এই পানের এই অতিরিক্ত মূল্যের কারণ হিসেবে তিনি জানিয়েছিলেন, ভারতের এলাহাবাদ, লখনউ, চেন্নাইয়ের মতো বিভিন্ন জায়গা থেকে পান সাজার জন্য বাছাই করা সেরা উপকরণগুলি আনা হয়। আর তা দিয়েই তৈরি হয় এই ‘কল্পতরু স্পেশাল’। সবথেকে উৎকৃষ্ট মানের জিনিস দিয়ে তৈরি হয় এই পান!
চলুন দেখে নেওয়া যাক ১০০১ টাকা দামের ‘কল্পতরু স্পেশাল’ পানটিতে ঠিক কী কী থাকে! দোকানে কর্ণধার জানিয়েছেন এই পানে থাকে নেহরু পাতি, জাফরানে সংরক্ষিত সুপুরি, জনকপুরী খয়ের, মুক্তাভস্ম চুন, লং কেশর, বিশেষ মিক্সচার এবং আসল রুপোর তবক।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৩৭ সাল নাগাদ স্বাধীনতার বেশ কয়েক বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই দোকানটি। সেই সময় এই দোকানটি পানের গুণগতমান এতই উন্নত ছিল যে, বর্তমানের ৫০১ দামের বাদশাহী পান মুখে দিয়ে কেউ পাড়ায় ঢুকলে নাকি গোটা পাড়ায় সেই গন্ধ পাওয়া যেত। ব্রিটিশ সরকারের মুখেও পড়েছিল সেই পান। পেয়েছিল উচ্চ প্রশংসা! ইন্দিরা গান্ধী, সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ, উত্তম কুমার, মান্না দে, পিসি সরকার কে না কল্পতরুর পান খাননি!
জানা যায়, ওই দোকানের বিজ্ঞাপনও ছিল চমকপ্রদ! নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রেখেই কল্পতরুর পান মুখে পুরছেন! যা অবাক করেছিল মানুষকে। ‘পদর্পণ করে বদন প্রসন্ন করুন’ লেখা ছাড়াও একটি বোর্ডে বিচিত্র সবনাম সহযোগে বহু পানের দাম টাঙ্গানো থাকতো।
জানা যায়, শুধুমাত্র কলকাতার মানুষ নন, কল্পতরু ভাণ্ডারের পান খেতে ভিন রাজ্য থেকেও বিভিন্ন মানুষ ছুটে আসতেন। একটা সময় তো নাকি হেদোর পুকুর পাড়ের দুর্গা ঠাকুর দেখে বেরিয়ে, ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট হলের সামনে কল্পতরুর ভান্ডার থেকে পান কিনে মুখে না দিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়াতে না বাঙালি। আজও তিলোত্তমার বুকে সেই প্রাচীন পানের ঐতিহ্যকে বয়ে নিয়ে চলেছে কল্পতরু পান সেন্টার!
আপনার মতামত লিখুন :