হিন্দুদের বহু অনুষ্ঠান, বহু উপাচার, পার্বন! আর তারমধ্যে অন্যতম হল চৈত্র সংক্রান্তিতে হিন্দুদের, চড়কের পুজো। যুগ যুগ ধরে এই পুজোর সঙ্গে বিভিন্ন কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুরের জলশ্বর শিবের গাজন উপলক্ষে কয়েক`শ বছরের পুরনো মেলা বসে। শিব ঠাকুরের ধাম তারকেশ্বরও গাজনের মেলা বসে। হুগলীর চণ্ডীপুর গ্রাম, বাঁকুড়া জেলার খামারবেড়ে গ্রাম সহ গ্রাম বাংলার একাধিক জায়গায় শিবের গাজন ও চড়কের মেলা বসে। মূলত গ্রামবাংলার কৃষিপ্রধান অঞ্চলগুলিতে বেশি করে চড়ক পুজো উদযাপিত হয়। এই পুজো কার্যত উৎসবের আকার ধারণ করে।
চড়কের পুজোর সূচনা নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। চলুন যুগ যুগ ধরে প্রচলিত এই পুজোর সঙ্গে জড়িত কাহিনি জেনে নেওয়া যাক-
প্রচলিত লোককথা অনুযায়ী জানা যায় যে, ১৪৮৫ সালে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামক এক রাজা এই প্রথম চড়কের পুজোর প্রচলন করেন। যদিও রাজা দ্বারা প্রচলিত পুজো হলেও চড়ক পুজো কোনদিনই রাজবাড়ির পুজো ছিল না। এটি বলা চলে হিন্দু সমাজের একটি প্রচলিত লোক সংস্কৃতি।
হিন্দু ধর্মের সমস্ত পুজতেই ব্রাহ্মণদের রমরমা থাকলেও এই পূজার ক্ষেত্রে নিয়ম আলাদা। চড়কের পুজোয় ব্রাহ্মণদের প্রয়োজন হয়না।চড়ক পুজোর সন্ন্যাসীরা ছিলেন হিন্দু ধর্মের তথা কথিত নীচু সম্প্রদায়ের লোক। তাঁরাই এই পুজোর সর্বেসর্বা।
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় চড়ক পুজো বিভিন্ন নামে অভিহিত। যেমন কোথাও এই পুজো শিবের গাজন, গম্ভীরা পুজো, নীল পুজো ইত্যাদি বিভিন্ন নামে খ্যাত! চড়কের পুজোর নিয়মও আলাদা। যেমন চড়কের পুজোর আগের দিন চড়ক গাছকে পরিষ্কার করে একটি জল ভর্তি ঘটে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয় সেখানে। আর এই প্রতীক শিবলিঙ্গটিকে `বুড়োশিব` বলা হয়ে থাকে। উল্লেখযোগ্য বিষয়ে জানেন, এই পুজোর মূল পৌরোহিত্য করেন পতিত ব্রাহ্মণেরা।
তবে চড়কের পুজোয় এমন কিছু বিশেষত্ব আছে যা শুনলে বা দেখলে আপনার গা শিউরে উঠতে পারে। চড়কের পুজোয় অনেকেই জ্বলন্ত ছাইয়ের ওপর দিয়ে হাঁটেন, কাঁটা, ছুরি বা অন্যান্য কোনও ধারালো কিছুর ওপর লাফানো, পিঠে আংটা ঝুলিয়ে ঝোলা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড দেখলে গা শিউরে ওঠে বৈকি! এছাড়াও হয় শিবের বিয়ে,অগ্নিনৃত্য ইত্যাদি! আর এই সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা হয়।
এইগুলিকে চড়ক পুজোর বিশেষ অঙ্গ হিসাবে মনে করা হয়। এই পুজোয় বিশ্বাসীদের বিশ্বাস নানা রকমের দৈহিক যন্ত্রণা এই পুজোর অঙ্গ। চড়কপুজোয় চড়কগাছের সঙ্গে ভক্তদের পিঠে লোহার হুড়কো বেঁধে দিয়ে দ্রুতবেগে ঘোরানোর রীতি আছে। একইসেই সঙ্গে পিঠে, হাতে, পায়ে, জিভে এবং শরীরের অঙ্গে লোহা গেঁথে দেওয়া হয়। অর্থাৎ দৈহিক কষ্টপ্রাপ্তি এই পুজোর অন্যতম অংশ।
প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য এই পুজোর এইসব কষ্টকর নিয়ম দেখে ১৮৬৫ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার আইন করে এই প্রথা বন্ধ করে দিলেও আজও গ্রামবাংলার অনেক স্থানে এই ভাবে চড়ক পুজো পালন করা হয়।
আপনার মতামত লিখুন :