প্রচলিত বিশ্বাস রয়েছে, যে নারীর সন্তান বাঁচে না, তাঁর কাছ থেকে অন্য কেউ সন্তান কিনে নিলে সে সন্তানের নাকি গোত্রন্তর ঘটে। ফলে তাঁর মৃত্যুভয় কেটে যায়। দীর্ঘজীবন লাভ করে সে৷ এই বিশ্বাস থেকেই জন্মমুহূর্তে তিন মুঠো ক্ষুদ দিয়ে মায়ের কাছ থেকে তাঁকে কিনে নেন বড়দিদি অপরূপা। `ক্ষুদ দিয়ে কেনা’ হয়েছিল বলে ছেলের নাম রাখা হয়েছিল ‘ক্ষুদিরাম`। যিনিই পরবর্তীতে দেশের অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী ক্ষুদিরাম বসু নামে চিরপরিচিত।
১৮৮৯ সালের ৩ ডিসেম্বর বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশপুর থানার অন্তর্গত মৌবনী (হাবিবপুর) গ্রামে জন্ম নেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু। তিন কন্যা সন্তান – অপরূপা, সরোজিনী ও ননীবালার পর পুত্রের জন্ম দেন মা লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী৷ এর আগে তাঁর কোনও পুত্র সন্তানই বাঁচত না৷ এ জন্য মেদিনীপুর শহরের প্রসিদ্ধ সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে লক্ষ্মীপ্রিয়া দেবী রোজ পুজো দিতেন একটি পুত্র সন্তানের জন্য। অবশেষে মা কালী তাঁর আর্জি শোনায় মায়ের কোল আলো করে এলেন ক্ষুদিরাম।
ছেলেবেলা থেকেই ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন ক্ষুদিরাম। আর ছিল ডিটেকটিভ বই পড়ার নেশা। তখনকার দিনের বিখ্যাত গোয়েন্দা গল্পের লেখক পাঁচকড়ি দে’র লেখা গল্প ছিল তাঁর খুব প্রিয়। পাশাপাশি নিজের শরীরচর্চার দিকেও ছিল বিশেষ নজর৷ আর অল্পবয়স থেকেই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেকে সমর্পণ করার ইচ্ছে জেগে ওঠে ক্ষুদিরামের মনে।
ক্ষুদিরাম যখন মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র, তখন স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন রাজনারায়ণ বসু। তাঁর এক ভাইপো জ্ঞানেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন সেই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক। এঁরা দুজনেই মিলিতভাবে ছাত্রদের মনে দেশপ্রেমের ভাবনা জাগিয়ে তুলতে লাগলেন। এরপর বিপ্লবী বারিন্দ্র কুমার ঘোষের মতো বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন ক্ষুদিরাম। তাঁর আদর্শে দীক্ষিত হয়েই মাত্র ১৫ বছর বয়সে দেশকে বাঁচানোর লড়াইয়ে সামিল হন তিনি।
বয়স যখন ১৬, ক্ষুদিরাম তখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে থানার কাছে বোমা ছুঁড়েছিলেন। এরপর স্থানীয়দের মধ্যে ব্রিটিশবিরোধী পুস্তিকা বিতরণের জন্য তাঁকে আটকও করে ইংরেজ শাসকরা। ক্ষুদিরাম ছিলেন বিখ্যাত অনুশীলন সমিতির সদস্য। তাঁর উপর দায়িত্ব এসে পড়ে প্রধান প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট ডগলাস কিংসফোর্ডকে হত্যার।
১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসে, কিংসফোর্ডকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে মুজফফরপুরে একটি গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেন ক্ষুদিরাম বসু ও আরেক বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ম্যাজিস্ট্রেট সেই গাড়িতে ছিলেন না। তাঁর বদলে গাড়িতে থাকা দুই মহিলা মিসেস কেনেডি ও তাঁর কন্যা মারা যান। আর ব্রিটিশ ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার চেষ্টা করার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন ক্ষুদিরাম। তাঁকে ফাঁসির হুকুম দেওয়া হয়।
১৯০৮ সালের ১১ অগাস্ট মাত্র ১৮ বছর বয়সে ফাঁসির মঞ্চে ওঠেন ক্ষুদিরাম। গুনগুন করে গাইতে থাকেন, ‘হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে ভারতবাসী’। এরপর হাসতে হাসতেই ফাঁসিতে চড়েন ভারতের এই বীর স্বাধীনতা সংগ্রামী। এভাবেই ভারতের সর্বকনিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এই বীর সন্তান। আজও প্রতিটা ভারতবাসীর মনের মনিকোঠায় অমর হয়ে রয়েছেন বীর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম।
আপনার মতামত লিখুন :