বাংলার লোকসঙ্গীতের অন্যতম একটি ধারা হল গম্ভীরা। এটি মূলত বর্ণনামূলক গান। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলাতে গম্ভীরার ব্যাপক প্রচলন দেখা যায়। গম্ভীরা আদতে দলবদ্ধভাবে গাওয়া হয়। `গম্ভীরা’ আবার এক প্রকার উৎসবও বটে। মনে করা হয় যে, গম্ভীরা উৎসবের প্রচলন হয়েছে মহাদেবের পুজো`কে কেন্দ্র করে। শিবের অপর নাম ‘গম্ভীর’, আর তাই শিবের উৎসব গম্ভীরা উৎসব নামে খ্যাত এবং মহাদেবের বন্দনাগীতিই হলো গম্ভীরা গান।
গম্ভীরা গানের মধ্যে দিয়ে সমাজের সমসাময়িক বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরা হত এবং তার সমাধানও বাতলে দেওয়া হত। আগে গম্ভীরা গানের আসরে মহাদেবের অস্তিত্বকে কল্পনা করা হতো। গম্ভীরা ছিল মূলত দুই প্রকার যেমন- আদ্যের গম্ভীরা ও পালা-গম্ভীরা। দেবদেবীকে সম্বোধন করে মানুষের সুখ-দুঃখকে আদ্যের গম্ভীরার মাধ্যমে প্রকাশ করা হতো। কখনও কখনও গোটা বছরের প্রধান ঘটনাসমূহকে এই গানের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত করা হতো! আর পালা-গম্ভীরায় অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে সমাজের বিভিন্ন সমস্যাকে তুলে ধরা হতো। আর বছর শেষে চৈত্র-সংক্রান্তিতে পালা-গম্ভীরা পরিবেশন করা হতো। যদিও বর্তমান সমাজে ‘গম্ভীরা’ বললেই বিশেষ একটি অঞ্চলের লোকসঙ্গীতকে বোঝানো হয়।
মনে করা হয়, এই গম্ভীরা গানের উৎপত্তি হয় পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় হিন্দুসমাজে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর মালদহ থেকে সেই গম্ভীরা গান রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জে চলে আসে। সেই সময় থেকে এই গানের পৃষ্ঠপোষক হয় মুসলিম সমাজ। আর তারপর থেকে স্বাভাবিকভাবেই এই গানের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন আসে। পরে তা ধীরে ধীরে রাজশাহী, নবাবগঞ্জ, নওগাঁ প্রভৃতি স্থানে এই গান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই জায়গাগুলি পরে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়!
উল্লেখ্য, এক সময় গম্ভীরা গানে ধ্রুপদী তালের দেখা মিলত যেমন একতাল, দাদরা, ত্রিতাল, খেমটা, কাহারবা প্রভৃতি সুরে গাওয়া হতো। কিন্তু যুগের হাওয়ায় বর্তমানে এই সুরের পরিবর্তন ঘটেছে এবং সেখানে জায়গা করে নিয়েছে হিন্দি ও বাংলা ছায়াছবির গানের সুর।
মূলত মালদহের নিম্নবর্ণের হিন্দু, কোচ-রাজবংশী, পোলিয়া সম্প্রদায়ের মানুষজন এই উৎসবে অংশগ্রহণ করেন। মালদহে গম্ভীরা উৎসব চার দিন ধরে পালন করা হয়। প্রথমদিন হয় `ঘটভরা` অনুষ্ঠান।শিবের মণ্ডপে ঘট স্থাপন করে র উদ্বোধন করা হয়। দ্বিতীয় দিনে হয় `ছোট তামাশা`; এই দিনে শিব ও পার্বতীর পুজো হয়। এই দিন তামাশা, আনন্দ, রসিকতার মধ্যে দিয়ে কাটে। মণ্ডপে নানা নৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। তৃতীয় দিনে `বড়ো তামাশা।` এই দিন সন্ন্যাসীরা শুদ্ধচিত্তে শুদ্ধাচারে কাঁটা-ভাঙ্গা, ফুল-ভাঙ্গা ও বাণফোঁড়ায় অংশ নেয়।ওইদিন মালদহ জুড়ে বিভিন্ন সঙের দল রাস্তায় ঘোরে; রাতে গম্ভীরা মণ্ডপে চামুণ্ডা, নরসিংহী, কালীর মুখোশ পড়ে মুখোশনৃত্য অনুষ্ঠিত হয়। চতুর্থ দিনের উৎসবের নাম ‘আহারা’। এই দিন মণ্ডপে শিবের সঙ্গে নীলপুজোও হয়, একইসঙ্গে গম্ভীরা গান গাওয়া হয়ে থাকে। বিকালবেলায় রাস্তায় সঙ বেরোয়। উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়িতে এই গান গমীরা নামে খ্যাত।
আপনার মতামত লিখুন :