শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪

জীবনকে বিদায় ‘চাঁদের বাড়ি’র নির্মাতা তরুণ মজুমদারের! বাংলা চলচ্চিত্রের বর্ণময় যুগের অবসান

আত্রেয়ী সেন

প্রকাশিত: জুলাই ৪, ২০২২, ১২:২১ পিএম | আপডেট: জুলাই ৪, ২০২২, ০৬:৩১ পিএম

জীবনকে বিদায় ‘চাঁদের বাড়ি’র নির্মাতা তরুণ মজুমদারের! বাংলা চলচ্চিত্রের বর্ণময় যুগের অবসান
জীবনকে বিদায় ‘চাঁদের বাড়ি’র নির্মাতা তরুণ মজুমদারের! বাংলা চলচ্চিত্রের বর্ণময় যুগের অবসান

বংনিউজ২৪x৭ ডিজিটাল ডেস্কঃ অবশেষে হার মানলেন তিনি। জীবনকে চীর বিদায় জানালেন ‘চাঁদের বাড়ি’র নির্মাতা তরুণ মজুমদার। তাঁর প্রয়াণের সঙ্গে সঙ্গে অবসান হল বাংলা চলচ্চিত্রের এক বর্ণময় যুগের। চলতি বছরের জুন মাসেই কিডনি এবং ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বর্ষীয়ান এবং প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র পরিচালক। তারপর থেকেই জারি ছিল লড়াইটা। অবশেষে জীবনযুদ্ধে হার মানলেন তিনি। বিদায় জানালেন ‘চাঁদের বাড়ি’র নির্মাতা। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। 

হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর, তাঁর অবস্থার অবনতি হওয়ায়, কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁকে উডবার্ন ওয়ার্ড থেকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাঁর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু ফের একবার তাঁর অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। রবিবার তাঁকে ভেন্টিলেশনে দিতে হয়। আপ্রাণ চেষ্টা করলেও, সেখান থেকে আর তাঁকে ফেরাতে পারলেন না চিকিৎসকেরা। সোমবার সকাল ১১ টা ১৭ মিনিট নাগাদ মৃত্যু হয় এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালকের। 

হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছিল, পরিচালকের সেকেন্ডারি ইনফেকশন হয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, আচমকাই পরিচালকের সেকেন্ডারি ইনফেকশন হওয়ায় পরিচালকের স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। গত শুক্রবারই মেডিক্যাল বোর্ডের চিকিৎসকরা প্রবীণ এই পরিচালককে যখন পরীক্ষা করেছিলেন, তখনও তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল ছিল। কিন্তু শনিবার থেকে ফের একবার তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। শুক্রবার পরিচালকের এন্ডোস্কপি করা হয়। সেদিন পরিচালকের রক্তচাপ নিচের দিকে ছিল বলেও জানা গিয়েছে। পাশাপাশি পরিচালকের প্লেটলেট কাউন্ট বেড়েছিল। এরপর রবিবার মধ্যরাত থেকেই অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। পুরোপুরি আচ্ছন্ন অবস্থায় ছিলেন। জানা গিয়েছে,ডায়ালিসিসের প্রয়োজন থাকলেও ডায়ালিসিস দেওয়ার অবস্থায় তিনি ছিলেন না। ১০০ শতাংশ ভেন্টিলেটরি সাপোর্টে রাখা হয়েছিল। 

উল্লেখ্য, গত ২২ বছর ধরেই কিডনির অসুখে ভুগছেন পরিচালক। গত সপ্তাহেই কিডনির সমস্যা নিয়েই এসএসকেএম হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। এছাড়াও তাঁর ফুসফুসের সমস্যা ও ডায়াবেটিস রয়েছে। চেস্ট মেডিসিনের চিকিৎসক সোমনাথ কুণ্ড এবং মেডিসিনের চিকিৎসক সৌমিত্র ঘোষ, নেফ্রলজিস্ট অর্পিতা রায়চৌধুরী, কার্ডিওলজিস্ট সরোজ মণ্ডল, নিউরো মেডিসিনের চিকিৎসক বিমান রায়ের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি চিকিৎসক দল সবসময় তাঁকে পর্যবেক্ষণে রেখেছিলেন। তাঁদের আপ্রাণ চেষ্টা সেই সঙ্গে অসংখ্য অনুরাগীর প্রার্থনাও ফেরাতে পারল না বর্ষীয়ান এই পরিচালককে। 

বাংলা চলচ্চিত্রের এই প্রখ্যাত পরিচালকের জন্ম ব্রিটিশশাসিত ভারতে। তাঁর বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। নাম বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও, চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি তাঁর ঝোঁক তৈরি হয় একসময়। অপর দুই চলচ্চিত্র পরিচালক শচীন মুখোপাধ্যায় এবং দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে জোট বেঁধে ‘যাত্রিক’ নামে চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজ শুরু করেন। এই ত্রয়ীর পরিচালনায় প্রথম ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় ‘চাওয়া পাওয়া’ চলচ্চিত্রটি। সেই সুপারহিট চলচ্চিত্রের অভিনয়ে ছিলেন চীরসবুজ জুটি উত্তম-সুচিত্রা। ১৯৬০ সালে বানালেন ‘স্মৃতি টুকু থাক‍’। এই যাত্রিকের পরিচালনাতেই ১৯৬২ সালে নির্মিত হয় জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘কাঁচের স্বর্গ’।  সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন তরুণ মজুমদার, তাই তো বারবার তাঁর সিনেমায় বাস্তব রূপ পেত সাহিত্যকদের লেখা। বনফুল, বিমল কর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকের গল্প নিয়ে ছবি করতেন তিনি। আরও একটা বিশেষত্ব ছিল তাঁর ছবিতে। তাঁর ছবি মানেই রবিঠাকুরের সুর।

তবে, এর কয়েক বছর পরেই ১৯৬৫ সালে ‘যাত্রিক’ থেকে বেরিয়ে আসেন তরুণ মজুমদার। সেই বছরই তিনি আলোর পিপাসা’ এবং ‘একটুকু ভালবাসা’ নামের দু’টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এরপর থেমে থাকেননি। একের পর এক সুপারহিট বাংলা ছবি দর্শককে উপহার দিয়েছেন। সেইসব চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘বালিকা বধূ’, ‘কুহেলি’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘আপন আমার আপন’, ‘গণদেবতা’, ‘চাঁদের বাড়ি’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’, ‘আলো’র মতো সিনেমা।

তাপস পাল, মহুয়া রায়চৌধুরী, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের মতো বাংলার তাবড় তাবড় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রথম অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। তাঁর স্ত্রী সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গেও ২০টি ছবি বানিয়েছেন তিনি। করোনাকালে লকডাউনে পরিচালক তরুণ মজুমদার আবারও বই এবং চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেছিলেন।

নিজের দীর্ঘ কর্মজীবনে একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন এহেন প্রখ্যাত ও কিংবদন্তি পরিচালক। ১৯৯০ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মানও। যৌথ পরিবারের আসল অর্থ এবং গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলোকে চলচ্চিত্রের পর্দায় স্বযত্নে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি বালিকা বধূ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘আলো’, ‘চাঁদের বাড়ি’র মতো সিনেমার মধ্যে দিয়ে।