দিনের পর দিন দেশে বাড়ছে কর্মহীনের সংখ্যা। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতির নাজেহাল অবস্থা হয়েছিল৷ এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও বেকারত্বের সমস্যা কমেনি। বরং ক্রমশ যেন তা আরও প্রকট হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার পরও চাকরি পাচ্ছেন না দেশ তথা রাজ্যের অজস্র তরুণ-তরুণী৷ ফলে অনিশ্চয়তা ও হতাশা মধ্যেই দিন কাটছে তাঁদের। তবে কিছু কিছু জন এই হতাশা কাটিয়েই জেগে উঠছেন নতুন উদ্যোমে। মানসিক জেদ আর ইচ্ছাশক্তির জোরে আগামী জন্য নতুন পদক্ষেপ নিচ্ছেন তাঁরা। আগেও এরকম বহু উদাহরণ উঠে এসেছিল নেটমাধ্যমের পর্দায়। এবার সেই তালিকায় জুড়ল আরও দুই নাম, আলমগীর খান ও রাহুল আলি।
হাবড়ার তরুণী টুকটুকি দাসের কথা মনে আছে? ইংরেজিতে মাস্টার্স ডিগ্রি করার পরও চাকরি মেলায় নিজের পায়ে দাঁড়াতে হাবড়া রেল স্টেশনের উপর চায়ের দোকান খুলেছিলেন তরুণী। নাম দিয়েছিলেন `MA ইংলিশ চাওয়ালি`। কারণ তাঁর চোখে ছিল স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন। এবার ঠিক সেই পথেরই পথিক হলেন মালদার দুই যুবক আলমগীর খান ও রাহুল আলি।
মালদহের কালিয়াচক হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন আলমগীর খান। তারপর গনি খান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ২০১৭ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা করেন এবং ২০২১ সালে কলকাতার স্বামী বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনলজি থেকে বি.টেক পাশ করেন। দু’টি ক্ষেত্রেই ৮০ শতাংশের বেশি নম্বর ছিল তাঁর। কিন্তু চাকরির ভাগ্য সহায় হয়নি। অন্যদিকে রাহুলও ২০১৭ সালে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সার্টিফিকেট ও ডিপ্লোমা কোর্স করেন। তিনিও বহু দৌড়ঝাঁপ করেন, কিন্তু চাকরির ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি।
তবু হাল ছাড়েননি এই দুই যুবক। চেষ্টা জারি রেখেছিলেন। এদিকে আলমগীরের বাবা শাহেনশা খান ঢালাই মেশিন (ছাদ ঢালাইয়ের কাজে ব্যবহৃত) ভাড়া দিয়ে পাঁচ ছেলেমেয়েকে নিয়ে সংসার চালান। রাহুলের বাবা মনসুর আলি পেশায় ট্যাক্সি চালক। সংসার চালাতে দুই পরিবারেরই হিমশিম খাওয়ার মতো অবস্থা!
এই পরিস্থিতিতে সংসারের হাল ধরতে এগিয়ে এলেন দুই যুবক। আলমগীর এবং রাহুলের হাত ধরে গড়ে উঠল `বি.টেক চাওয়ালা`। ইংরেজবাজার শহরের স্টেশন রোডে কানি মোড়ে ভাড়া নিয়ে এই চায়ের দোকান খুলেছেন দুই যুবক। রবিবার রাতে, ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিনই দোকানের উদ্বোধন হল। যার বাইরে জ্বলজ্বল করছে লেখা, `আ প্লেস টু টক’। আর পাঁচটা মোড়ের মাথার চায়ের দোকানের মতো নয় এই দোকান। এখানে বাইরে দাঁড়িয়ে চা যেমন খেতে পারবেন, ভিতরে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দেওয়ারও ব্যবস্থাও রয়েছে।
কিন্তু কেন হঠাৎ চায়ের দোকান? আলমগীর আর রাহুলের কথায়, কোনও কাজই ছোট নয়৷ রাহুল বলেন, "চায়ের দোকানে বসে প্রচুর সময় কাটিয়েছি। ভাল চা বিক্রি করলে মানুষ এমনিই আসবেন। সে জন্যই চায়ের দোকান দেওয়া। কোনও কাজই যে ছোট না, তা বোঝাতেই দোকানের নাম বি. টেক চাওয়ালা।"
আলমগীর জানান, "চাকরি হবে না সেটা বুঝতে পারছি। কেন্দ্রের মতো রাজ্য সরকারও বেকারত্ব নিয়ে উদাসীন। বাজারে চাকরির অভাব। বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা, ভাইবোন রয়েছে। কীভাবে সংসার চালাব? গুজরাটে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাউন্সিলিং-এ চাকরি মিলেছিল। কিন্তু মাইনে মাত্র ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। এই টাকায় নিজেই বা খাব কী? বাড়িতেই বা কী পাঠাব? এদিকে ২৭ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে। চাকরির আশায় বসে থাকলে, বয়স থেমে থাকছে না। কিছু করার জন্য চায়ের দোকান খুলেছি।"
এদিকে ছেলের এই নতুন ব্যবসা নিয়ে খুশি আলমগীরের পরিবারও৷ তাঁর বাবা জানিয়েছেন, "ছেলে বি.টেক পাশ করে চায়ের দোকান খুলছে শুনে অনেকেই অনেক কথা শোনাবেন। কিন্তু বসে থাকার চেয়ে চায়ের দোকান খোলা অনেক ভালো।"
মালদার এই দুই যুবকের উদ্যোগকে এখন কুর্নিশ জানাচ্ছে নেটদুনিয়াও। কে বলতে পারে, আগামীতে হয়তো এই দুই যুবকই নিজেদের ব্যবসার মাধ্যমে হয়ে উঠতে পারেন রাজ্য তথা দেশের অন্যতম এক অনুপ্রেরণা!