দেশের স্বার্থে নেতাজির আত্মবলিদানের কথা আজ কারোর অজানা নয়। দেশকে তিনি নিজের মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করতেন। প্রাণপণ ভালোবাসতেন দেশের সাধারণ মানুষজনকে। তাদের সুবিধার্ধে হেন কোনও কাজ ছিল না যা করতে পিছপা হতেন তিনি। জনগণের স্বার্থে সেই নেতাজিকেই একবার পালন করতে হয়েছিল ট্যাক্সিচালকের ভূমিকা। কলকাতার রাস্তায় চালাতে হয়েছিল ট্যাক্সি।
সময়টা তখন ১৯২১ সাল। দিনটা নভেম্বরের ১৭। খবর এল ইংল্যান্ডের যুবরাজ `প্রিন্স অব্ ওয়েলস` আসছেন ভারত পরিদর্শনে। শুনে কংগ্রেসের ডাকে কলকাতা জুড়ে জারি হল বনধ। এদিকে বিপদে পড়লেন সাধারণ মানুষ। বনধের দিন হাওড়া স্টেশনে আটকে পড়লেন তারা। ঠিক তখনই ট্যাক্সি নিয়ে হাজির হলেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু। গাড়ির সামনে লেখা, `অন ন্যাশনাল সার্ভিস ( On National Service)। সেই গাড়িতেই মহিলা এবং শিশুদের তুলে প্রত্যেককে নিজেদের বাড়িতে পৌঁছে দিলেন সুভাষচন্দ্র বসু।
এই প্রসঙ্গে ঘটনাটির উল্লেখ রয়েছে নলিনীকান্ত সরকারের আত্মজীবনী, ‘আসা যাওয়ার মাঝখানে’ বইয়ের দ্বিতীয় খন্ডতেও। তাঁর সেই বই থেকেই নীচে রাখা হল ঘটনার বিবরণ -
"তারিখটা ১৬ই জুলাই ১৯২১। সুভাষচন্দ্র বসু বিলেত থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। আই.সি.এস. পরীক্ষা দেবার জন্য তাঁর বাবা তাঁকে বিলেতে পাঠিয়েছিলেন। পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার ক’রে উত্তীর্ণ হয়েও তিনি এই মর্যাদাপূর্ণ বহুজনকাম্য আই. সি. এস পদ প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি বোম্বাই বন্দরে নেমেই সরাসরি মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করলেন। মহাত্মা গান্ধী তাঁকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের সঙ্গে মিলিত হয়ে দেশের কাজ করবার পরামর্শ দিলেন।
কলকাতায় এসে সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসে যোগ দিলেন। যোগ্য সহকারী পেয়ে চিত্তরঞ্জনের শক্তি যথেষ্ট বৃদ্ধি পেল। সুভাষচন্দ্র এসে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। কলকাতার সাময়িক-পত্রগুলি থেকে তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন দেশের গতিপ্রকৃতি।
এদিকে ইংলণ্ডের যুবরাজ প্রিন্স অব্ ওয়েলস আসছেন তাঁর জমিদারী ভারতবর্ষ পরিদর্শনে। ১৭ই নভেম্বর তিনি বোম্বাই বন্দরে পদাপর্ণ করবেন। সরকারপক্ষ যুবরাজের যথোপযুক্ত অভ্যর্থনার জন্য যেমন উদ্যোগী হয়েছেন, কংগ্রেস কর্তৃপক্ষও তেমনি এই রাজকীয় অভ্যর্থনা বর্জনের জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন।
যুবরাজের আগমনের দিন কলকাতায় দোকানপাট যানবাহন-চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ। কেবলমাত্র একটি গাড়ি নিয়ে সুভাষচন্দ্র চলেছেন হাওড়া স্টেশন অভিমুখে। গাড়ির সম্মুখে বড় বড় হরফে লেখা On National Service. হাওড়া স্টেশন থেকে শিশু ও স্ত্রীলোকদের গাড়িতে তুলে নিয়ে তিনি তাঁদের নিজ নিজ বাসভবনে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। এ রকম সুনিয়ন্ত্রিত সুশৃঙ্খল হরতাল কলকাতায় এর আগে দেখা যায় নি।"