উত্তরপ্রদেশের গোন্ডা জেলখানা। প্রতি বছরই ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ সেই জেলা কারাগারের ভিতর একটি বিশেষ স্মরণ সভার আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। উদ্দেশ্য এক বাঙালি শহীদ সন্তান। কারাগারের ভিতরেই অবস্থিত তাঁর আবক্ষ মূর্তি। সেখানেই নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে সম্মান প্রদর্শন করে জেলার বিভিন্ন স্কুল থেকে আসা ছাত্রছাত্রী। উপস্থিত থাকেন আরও বহু নাগরিকবৃন্দ। সরকারি ভাবে এই দিনটি সেখানে `লাহিড়ী দিবস`।
কিন্তু কে এই বীর বাঙালি শহীদ? মৃত্যুর পরও যাঁর স্থান উত্তরপ্রদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়েই? তিনি বিপ্লবী রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী। ১৯২৭ সালে আজকের দিনেই ইংরেজদের হাতে ফাঁসি হয় তাঁর। তবে সে মৃত্যুও ছিল বীরের মতোই...
১৯০১ সালে অধুনা বাংলাদেশের পাবনা জেলার এক জমিদার পরিবারে জন্ম নেন রাজেন্দ্রনাথ। বাড়িতে স্বদেশী মনোভাব ছিল ভরপুর। সেই সূত্রেই যুবা বয়সে কলেজে পড়ার সময়ই জড়িয়ে পড়েন সশস্ত্র আন্দোলনে। ১৯২৫ সাল আরও বেশ কিছু বিপ্লবীর সঙ্গে মিলিত হয়ে উত্তর প্রদেশের কাকোরিতে লক্ষ্ণৌ-শাহজাহানপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেন লুট করেন রাজেন্দ্রনাথ। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে সেবারই প্রথম বিপ্লবীর হাতে ঘটে ট্রেন লুটপাট।
কিন্তু শেষ মেশ ধরা পড়লেন তিনি। বিচারে এল ফাঁসির হুকুম। দিন স্থির হল ১৭ ডিসেম্বর। তাঁকে নিয়ে আসা হল উত্তরপ্রদেশের সেই গোন্ডা কারাগারে। তিনি যতদিন জেলে ছিলেন একদিনও শরীরচর্চায় কোনও খামতি হতে দেননি। এমনকি ফাঁসির দিনও ভোরবেলা উঠে পুজোপাঠ সেরে শুরু করলেন শরীরের কসরৎ।
তাঁকে দেখে জেলার সাহেব অবাক। আজই তাঁর ফাঁসি অথচ তিনি হাসিমুখে ব্যায়াম করে চলেছেন! কৌতুহল বশে জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন তিনি। অপরদিক থেকে হাসতে হাসতেই এল উত্তর, "জেলার সাহেব, আমি হিন্দুর ছেলে। তাই পুনর্জন্মে বিশ্বাস রাখি । পরের জন্মে সুস্থ শরীর নিয়ে না জন্মালে এ জন্মের যা অসমাপ্ত কাজ তা শেষ করবো কী করে? আফশোষ একটাই! এ জন্মে দেশকে স্বাধীন করতে পারলাম না। তবে পরের জন্মে ঠিক স্বাধীন করবোই।"
এরপর ঘনিয়ে এল ফাঁসির সময়। হাতে হাতকড়া পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার সময় বেশ উত্তেজিতই হয়ে উঠলেন রাজেন্দ্রনাথ। মৃত্যুর আগেও কি যথাযথ সম্মানটুকুও দেওয়া হবে না তাঁকে?
জেলার জানালেন এ সবই উপর মহলের নির্দেশ। তাই জারি রইল নিয়ম। হাতকড়া হাতেই ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন লাহিড়ী। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সকাল আটটায় টানা হল হাতল। ফাঁসির মোম মাখানো দড়ি কেড়ে নিল সেই বাঙালি বিপ্লবীর প্রাণ।
ঠিক তার পরের বছর থেকেই সেই গোন্ডা জেলে ১৭ ডিসেম্বর পালিত হতে থাকল `লাহিড়ী দিবস` হিসাবে। মৃত্যুর আগে যে সম্মান তিনি পাননি, অমৃতলোকের পথে রওনা দেওয়ার পর পেলেন তাই-ই। সেই সম্মান রক্ষার্থে, আজও কারাগারের মধ্যেই তাঁর মূর্তির সামনে শ্রদ্ধার্ঘ্য জ্ঞাপন করেন উত্তরপ্রদেশের প্রশাসন।