ছোটবেলায় সাপ-সিঁড়ি খেলেনি এমন মানুষ হয়তো খুঁজলেও পাওয়া ভার। ভাই-বোন, বন্ধুদের সঙ্গে কতো অলস দুপুর কেটেছে এই খেলায়। একশোর ঘরে সবার আগে পৌঁছানোর লোভে কত যে ঘুঁটি এদিক ওদিক হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
তবে জানেন কি লুডুর মতো এই খেলাটিরও আবিষ্কার হয়েছিল ভারতে। বিবর্তনের ঠেলায় আজকের খেলার সঙ্গে সেই সময়ের খেলার আর তেমন মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই চেনা সাপ সিঁড়ি খেলার অজানা ইতিহাসই আজ আমরা খুঁজব।
পূর্বতন ভারতবর্ষে এই খেলাটির নাম ছিল `জ্ঞান চৌপার` বা `মোক্ষ-পতমু`। প্রচলিত ভাষায় যা পরিচিত ছিল `মোক্ষ-পট` নামে।
অনুমান করা হয় দশম শতকেরও বহু আগে ভারতে এই খেলার প্রচলন শুরু হয়।এবং প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উঠে আসে স্বামী জ্ঞানদেবের নাম।
মনে করা হয় শিশুদের নীতিশিক্ষা প্রদানের উদ্দেশ্যেই এই খেলা প্রচলিত হয়েছিল। যাতে তাঁরা শিশুকাল থেকেই নিজেদের ইচ্ছা ও ভাগ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পারে।
খেলায় নির্দেশিত মইগুলি হলো ভালো কাজের প্রতীক। আর সাপগুলি সেই সমস্ত বাজে কাজকে নির্দেশ করে যা আমরা করে ফেলি।
মইয়ে চড়লে যেমন খেলায় আমরা একশো ঘরের কাছে পৌঁছাতে পারি তেমন ভাবেই জীবনে একমাত্র ভালো কাজ করলেই মোক্ষলাভ করা বা পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আর মন্দ কাজ সেই সাপের লেজের মত যা আমাদের জীবনকে ক্রমাগত নীচের দিকে নামিয়ে দেয়।
আসল খেলায় মইয়ের চেয়ে সাপের আধিক্যই বেশি ছিল এটা বোঝানোর জন্য যে জীবনের পথ চলায় ভালোর চেয়ে মন্দের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনাই সব থেকে বেশি।
প্রাচীন খেলায় সদগুণ গুলি এবং সেটিকে নির্দেশ করার জন্য থাকা মইগুলি যে যে সংখ্যার মধ্যে ছিল সেগুলি হলো বিশ্বাস (১২), নির্ভরযোগ্যতা(৫১),উদারতা(৫৭),জ্ঞান(৭৬), এবং সন্ন্যাস(৭৮)।
মানুষের খারাপ দিকগুলি এবং নির্দেশ করার জন্য সাপগুলি যে সংখ্যায় থাকত সেগুলি হলো অবাধ্যতা(৪১), অসাড়ত্ব(৪৪),অশ্লীলতা(৪৯), চুরি(৫২),মিথ্যা বলা(৫৮), মাতলামি(৬২),ঋণ(৬৯), হত্যা(৭৩),ক্রোধ(৮৪), লোভ(৯২),আত্ম অহংকার(৯৫),কামনা(৯৯)।
ভারতীয় `মোক্ষ-পটে`র মতোই নেপালেও এই জাতীয় খেলা প্রচলিত ছিল। নেপালিরা শুদ্ধ ভাষায় এই খেলাকে `নাগপাশ` বললেও চলতি কথায় তাঁরা বলেন `বৈকুণ্ঠ খেল`। অনুমান করা হয় অবিভক্ত ভারত থেকেই এই খেলার প্রচলন নেপালে শুরু হয়েছিল।
`বৈকুণ্ঠ খেল`এ সিঁড়ির বদলে থাকতো লাল রঙের সাপ। এই সাপ সাফল্যের প্রতীক। আর কালো রঙের সাপ অশুভ শক্তির। জীবনের পথ চলার মতোই শৈশব,যৌবন, জরার পথ ধরে খেলোয়াড়কে এগোতে হত আর যাঁকে নিয়ন্ত্রণ করত লাল ও কালো রঙের সাপ। এবং এই খেলার একদম মাথায় থাকত ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের চিত্র।
ভারতীয় `মোক্ষ-পটে` খেলা শুরু হতো ৬৮ নম্বর ঘর থেকে। আর নেপালি নাগপাশ শুরু হতো ১ নম্বর ঘর থেকে।
সাপ-সিড়িঁর মধ্যে যে কর্মফল, আত্মজ্ঞানের কথা রয়েছে, সেসব প্রতীকি বিষয়গুলো হারিয়ে গিয়ে আজ তা নিছক খেলায় পরিণত হয়েছে।
তবে আধুনিক সাপ-সিড়িঁ খেলায় যে সাপ ও মইয়ের ব্যবহার দেখা যায়, তা এই জ্ঞান-চৌপার থেকেই এসেছে বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু খেলা শুরুর প্রক্রিয়া এসেছে নেপালি নাগপাশ থেকে।
ইংরেজরা ভারতবর্ষ দখল করার পর খেলাটির প্রতি তাঁরাও বেশ আকর্ষিত হয়ে পড়ে। এই খেলার চিন্তা-ভাবনা তাঁদেরকে বেশ মুগ্ধ করে। ১৯ শতকের শেষ দিকে ব্রিটিশরা এই খেলাটিকে তাঁদের নিজেদের উপযোগী করে তৈরি করে নেয়। সাপ-সিড়িঁর মুল থিম ঠিক রেখে নিজেদের ধর্মীয় আদর্শ এবং নানা উপদেশমূলক বাণী এতে সংযুক্ত করে।
ইংরেজদের তৈরি খেলাটি সে সময় ইউরোপ, আমেরিকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
বিংশ শতাব্দীতে এসে সাপ-সিঁড়ি খেলাটি কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের অনুসারিদের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে তা সার্বজনীন হয়ে ওঠে। ফলে খেলাটি বিভিন্ন বয়সী মানুষদেরকেও আকর্ষণ করে। বর্তমান সময়ে এসে ভিডিও গেমসের কল্যাণে এই ঐতিহাসিক ও জনপ্রিয় খেলাটি অনেকের মোবাইল ও কম্পিউটারে স্থান করে নিয়েছে। তাই কালের বিবর্তনে খেলাটিতে নানা পরিবর্তন আসলেও এর জনপ্রিয়তা আজও অমলিন।