১৫ই আগস্ট ১৯৪৭। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ রাজ হীন এক নতুন ভারতের। ২০০ বছরের ইংরেজ আধিপত্য ও নিদারুন অত্যাচারের এটিই ছিল শেষ দিন। কিন্তু এই নতুন দিনের শুভ সূচনা তো একদিনে হয়নি। মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে নামা দেশবাসীর দীর্ঘদিনের আন্দোলন, বিপ্লবের ফল ছিল সে। ফল ছিল দেশকে ভালোবেসে মৃত্যুবরণ করা শত সহস্র শহিদের প্রাণের । ফল ছিল কিছু অনমনীয়, হার না মানা দেশনায়কের জেদের। সে ফল ছিল তুখোড় দেশীয় রাজনীতির। তাদের আত্মত্যাগ, জেদেই নতুন করে জন্ম হয়েছিল নতুন ভারতের।
বলা হয় সেই অবিভক্ত ভারতবর্ষে সবথেকে বুদ্ধিশীল জাতি ছিল বাঙালি জাতি। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস ঘাঁটলেই তার স্বপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ ও মেলে। এমনও বলা হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবল জোয়ার এই বাংলা থেকেই উঠেছিল। কার্যত সেই কারনেই বাঙালির ক্ষমতা হরনের লক্ষ্যে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করতে বাধ্য হন। কিন্ত বাংলা বললেই আমাদের মনে আসে কলকাতা ও তার ইতিহাসের কথা। কিন্তু দেশীয় আন্দোলনে শুধুমাত্র কলকাতা নয় তৎসংলগ্ন অঞ্চলগুলির ইতিহাস ও যথেষ্ট চমকপ্রদ। আর ইতিহাসের মোড়কে মোড়া সেই রকমই দুটি অঞ্চল হলো চুঁচুড়া ও চন্দননগর। ব্রিটিশ শক্তি ভিন্ন সম্পূর্ণ অন্য দুই বৈদেশিক শক্তির হাতে গড়ে ওঠা এই শহর দুটি ছিল বৈপ্লবিক কাজকর্মের অন্যতম ঘাঁটি। প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে না থাকলে ও পরক্ষো ভাবে জড়িয়ে ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে।
আসলে একসময়ে বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ হুগলি নদীর তীরে বাণিজ্যের কারণে বসতি স্থাপন করে। পরে কুঠি গড়ে, উপনিবেশ স্থাপন করে। অন্যান্য শহরের মত ফরাসিরাও নিজেদের বাসস্থানের জায়গাটুকুই সাজিয়ে নেয় এবং তা নেয় এখানকারই অধিবাসীদের করের টাকায়। উপনিবেশ গড়ে রাজত্ব চালানোর সময়ে এরা সব কিছুর উপরেই কর চাপিয়েছে। হরিহর শেঠের বইতেই রয়েছে, ‘নদী দ্বারা যে সকল দ্রব্য আইসে এবং যাহারা পাইকারি বিক্রয় হয় তাহার উপর শতকরা এক টাকা কর দিতে হইত।
এখানকার নাগরিকদের বিয়ে, বাড়ি ঘর তৈরি, নদী বা পুকুর থেকে মাছ ধরতে, এমন কি নিজের জমিতে ধান বা অন্য শস্য তুলতেও কর দিতে হত। তা ছাড়া জমি কিনলে সেলামিস, স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরে চৌখাই ইত্যাদি কর তো ছিলই। এই সব করের টাকাতেই তাদের নিজেদের সাদা অঞ্চল সাজিয়ে তুলত। স্থানীয় নাগরিকদের বাসস্থানকে ওদের ভাষায় বলা হত ‘কালো অঞ্চল’ । সেসব অঞ্চলের প্রতি ওদের কোনও নজরই ছিল না।
হ্যাঁ একথা সত্যি, সাংস্কৃতিক শহর হিসেবে চন্দননগরের ঐতিহ্য প্রাচীন কাল থেকেই। সেটা ছিল তাদের নিজস্ব লোক সংস্কৃতি। শিল্পে, ব্যবসায়ে, সাহিত্যে এক গৌরবজনক ঐতিহ্য তৈরি করেছিল নিজেদের কর্মকুশলতায়। কুটির শিল্পেও এই শহর এক বিস্ময়কর উন্নতি করেছিল। এখানকার বস্ত্রশিল্পের খ্যাতির কথা কে না জানে! ফ্রান্সে চন্দননগরের খ্যাতি ছিল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে। এই শহরকে একসময়ে বলা হত ‘বাংলার শস্যাগার’। সব মুছে গিয়েছিল এদের বদান্যতায়। মূলত বাণিজ্যের প্রয়োজনে এখানে কুঠি গড়ে রাজত্ব শুরু করে ফরাসিরা। প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে ফরাসি ভাষা শিক্ষাও অবৈতনিক করে দেওয়া হয়েছিল। সরকারি স্কুলগুলিতে ফরাসি ভাষা ও ফরাসি ইতিহাস শিক্ষা শুরু হয়। ছাত্রছাত্রীদের মধ্য ঢুকিয়ে দেওয়া হত ইংরেজরা অত্যাচারী আর ফরাসিরা আমাদের গৌরবময়, স্বপ্নবৎ অতীত।
ফরাসিদের সম্বন্ধে আর একটি কথা শোনা গিয়েছিল যে স্বাধীনতা সংগ্রামে চন্দননগর এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল ফরাসি সরকারের সাহায্যে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই শহর বিপ্লবীদের এক কর্মকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এবং সেটা হয়েছিল ফরাসি সরকারের মদতে। এটাও একদম ভুল তথ্য। যেহেতু ফরাসি অধীনস্থ চন্দননগরে ব্রিটিশ আইন বা শাসন চলতো না, ফলে এখানে অনেক বিপ্লবী আত্মগোপন করার সুযোগ নিতেন। যেহেতু বিপ্লবীরাও ফরাসী সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করতো না, ফলে ফরাসীরাও এঁদের ঘাঁটাতেন না। কিন্তু ইংরেজরা যখনই সুযোগ পেতেন এখানে এসে তাদের ধরে নিয়ে যেতেন বা গুলি করে হত্যা করতো। ফরাসি সরকার এ ব্যপারে ইংরেজদের কিছুই বলতো না। এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে।
নলিনী দাস একটি নাম বিপ্লব ও সংগ্রামের । যে নামটি শুনলে চেতনা মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায়। কল্পনায় ভেসে ওঠে বিপ্লবী জীবনের প্রতিচ্ছবি । ভেসে ওঠে আন্দামান সেলুলার জেলের নিষ্ঠুর নির্মম অত্যাচারের ছবি। এহেন বিপ্লবীর জন্ম ১৯১০ সালের ১লা জানুয়ারী বরিশাল জেলার উত্তর শাহবাদপুরে। মাত্র ১২ বছর বয়স থেকেই তিনি কংগ্রেসীয় রাজনীতির সথে জড়িয়ে পড়েন। দুরন্ত , চঞ্চল , মেধাবী এই বালক ১৯২১ সালের কংগ্রেস ও খিলাফৎ কমিটির ৫ম শ্রেণীর ছাত্রাবস্থায় গ্রেপ্তার হন। কিন্তু এরপরেও তিনি দমে যাননি উপরন্তু ব্রিটিশ দের প্রতি তার বিদ্বেষ আরও বেড়ে যায়। ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হিজলী ক্যাম্পে ব্রিটিশ পুলিশ রাজবন্দীদের উপর গুলি বর্ষণ করে। এ সময় কলকাতার সন্তোষ মিত্র ও বরিশালের তারেকেশ্বর সেনগুপ্ত নিহত হন। আহত অবস্থায় নলিনী দাস ও ফনী দাসগুপ্ত হিজলী জেল থেকে পলায়ন করেন। আবার শুরু হয় পলাতক জীবন। ফরাসী অধিকৃত চন্দননগরের একটি বাড়ীতে আশ্রয় নিলেন নলিনী দাস, বীরেন রায় ও দিনেশ মজুমদার।
১৯৩২ সালে দিনের বেলায় পুলিশ চন্দননগরের ওই বাড়ি ঘেরাও করে। বিপ্লবীরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসেন। চন্দননগরের ৫/৬ মাইল দীর্ঘ রাস্তাজুড়ে ও বিভিন্ন পুলিশ ফাঁড়িতে মাত্র এই ৩ জন বিপ্লবী পুলিশের সঙ্গে দীর্ঘ ৪ ঘন্টাব্যাপী খণ্ডযুদ্ধ চালিয়ে যান। এতে পুলিশ কমিশনার কিউ নিহত হয়। শেষ পর্যন্ত বীরেন রায় গ্রেপ্তার হন। চন্দননগরের ঘটনার পর কর্নওয়ালিশ স্ট্রীটে বিপ্লবী কর্মী নারায়ণ ব্যানার্জীর বাড়িতে নলিনী দাস, দীনেশ মজুমদার ও জগদানন্দ মুখার্জ্জী আশ্রয় নিলেন।
আর ও এক স্বনাম ধন্য বিপ্লবীর সঙ্গে এই শহরের ছিল আত্মিক সম্পর্ক তিনি হলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। রাসবিহারী বসুর জন্ম বর্ধমানের সুবলদহ গ্রামে। পিতা বিনোদবিহারী বসুর কর্মক্ষেত্র চন্দননগরে তিনি শিক্ষালাভ করেন। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালায়। প্রাথমিক পাঠ শেষ করে চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজের প্রবেশিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু শৈশবে রাসবিহারী বসুর পড়াশুনার প্রতি তেমন মনোযোগ ছিল না। তবে ইংরেজী-ফার্সী ভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। ভারতবর্ষে শুধু ফার্সী ভাষা শিখলে চলবে না, তাই তাঁর বাবা তাঁকে কলিকাতা মটন স্কুলে ভর্তি করান। এই স্কুলে পড়াশুনার সময় তিনি ইংরেজী ভাষা শিক্ষা, খেলাধুলা ও ব্যায়ামের প্রতি আগ্রহী হন।
বাল্যকাল থেকে তিনি ইংরেজী ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করতেন যা তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হত। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। কিন্তু সুন্দরভাবে ইংরেজী বলতে ও লিখতে পারতেন। স্কুলে পড়াশুনার সময় চন্দননগরের মতিলাল রায়ের সাথে রাসবিহারী বসুর সৌহার্দ গড়ে উঠে। বন্ধু মতিলাল রায়ের মাধ্যমে তিনি অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে পরিচিত হন। শ্রী অরবিন্দের সংস্পর্শে তিনি যোগতত্ত্বের সন্ধান পান। তখন থেকেই রাসবিহারী বসু দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার সিদ্বান্ত নেন।
১৯০৮ সালে বড়লাটকে মারার জন্য ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী বোমা নিক্ষেপ করে। এই ঘটনার পর পুলিশ মানিকতলা মুরারীপুকুর উদ্যানে তল্লাশি চালায়। এইসময় পুলিশ রাসবিহারীর হাতে লেখা দু`টি চিঠি পায়। ওই বছর রাসবিহারী বসুকে `আলীপুর বোমা বিস্ফোরণ মামলা`য় গ্রেফতার করে বেশ কিছুদিন কারাগারে রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তিনি মুক্তি পান। ওই সময় শশীভূষণ রায় চৌধুরী নামে এক দেশপ্রেমিক দেরাদুনে শিক্ষকতা করতেন। তিনি রাসবিহারীর বিপদ দেখে নিজের চাকরিটি তাঁকে দিয়ে দেরাদুনে পাঠিয়ে দেন। দেরাদুনে শিক্ষকতা করার সময় রাসবিহারী বসু বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তবে ছুটি পেলেই তিনি চন্দনগরে চলে আসতেন।
এই চন্দননগরেই বাল্য বয়সে তাঁর সশস্ত্র বিপ্লববাদী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল। বছর দেড়েক শিক্ষকতা করার পর তিনি দেরাদুনে বন বিভাগের গবেষণাগারে কেরানির চাকরি নেন। ১৯১০ সালে তিনি বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের হেডক্লার্ক হয়েছিলেন। এসময় তিনি গোপনে বিপ্লবীদের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করেন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা এবং হুগলি জেলার চন্দননগর। চন্দননগরকে গুপ্ত সশস্ত্র কর্মকাণ্ড, আগ্নেয়াস্ত্রের লেনদেন এবং বোমা তৈরির কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু।