বাংলার যে সমস্ত জায়গার সঙ্গে ইতিহাস অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম জায়গা হল হুগলি জেলার শ্রীরামপুর। শ্রীরামপুরের কথা বললেই সবার আগে মাথায় আসে শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের নাম। আর উইলিয়াম কেরি এবং তাঁর শ্রীরামপুর মিশন প্রেস ছাড়া তো আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে ভাবাই যায় না। এর সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রথম লাইব্রেরি, প্রথম কাগজকল আর দ্বিতীয় কলেজও তৈরি হয়েছিল এই শ্রীরামপুরেই। সংস্কৃত চর্চার কেন্দ্র হিসেবেও এই প্রাচীন জনপদটির খ্যাতি রয়েছে।
মুঘল সম্রাট আকবরের সময়ে লেখা আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’-তে বলা আছে যে এখানকার শ্রীপুরে রাজা মানসিংহ তাঁর শিবির বসিয়েছিলেন। সম্রাট শাহজাহানের আমলে আবদুল হামিদ লাহোরি তাঁর ‘বাদশাহনামা’ বইতে শ্রীপুরকে উল্লেখ করেছিলেন শ্রীরামপুর হিসেবে। এই শ্রীরামপুর নামটা কোথা থেকে এল, তার সঠিক মীমাংসা এখনো হয়নি। শেওড়াফুলির রাজা মনোহরচন্দ্র রায় ১৭৫২ সালে একটি রামসীতার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন শ্রীপুরে। তাঁর ছেলে রামচন্দ্র শ্রীপুর, গোপীনাথপুর আর মনোহরপুর – এই তিনটে মৌজা দেবসেবার জন্য দেবোত্তর করে দেন কয়েকজন ব্রাহ্মণের নামে। এই শ্রীপুর কিংবা রামসীতার মন্দির থেকে গোটা অঞ্চলটির নাম শ্রীরামপুর হয়ে থাকতে পারে বলে অনেকে মনে করেন। এদিকে ততদিনে ইউরোপের বণিকরা বাংলায় এসে পড়েছেন।
১৮ শতকের মাঝামাঝি দিনেমার কোম্পানি দক্ষিণ ভারত থেকে সোয়েটম্যান নামের এক প্রতিনিধিকে নবাব আলিবর্দি খাঁর কাছে পাঠিয়েছিল বাণিজ্য করার অনুমতি পাওয়ার জন্য। সোয়েটম্যান ১৭৫৫ সালে শ্রীপুরে তিন বিঘে আর আকনায় সাতান্ন বিঘে জমি কিনে তাঁদের কুঠি বসান। তারপর শেওড়াফুলির জমিদারের থেকেও দিনেমার বণিকরা খাজনার বিনিময়ে অধিগ্রহণ করেন আরও কিছু জমি।
ডেনমার্কের রাজা পঞ্চম ফ্রেডরিকের নাম অনুসারে জায়গাটার নাম দেওয়া হয় ফ্রেডরিক্সনগর। দিনেমারদের উদ্যোগে এই ফ্রেডরিক্সনগর গড়ে উঠতে থাকে একটি আধুনিক শহর হিসেবে। ১৮৪৫ সালে দানিশরা এই শহর বিক্রি করে দেয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে। ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর শহরটারর নাম হয় শ্রীরামপুর। ওই ১৮৪৫ সালেই শ্রীরামপুর হুগলি জেলার একটা মহকুমায় পরিণত হয়েছিল আর ১৮৬৫ সালে তৈরি হয় শ্রীরামপুর পুরসভা।