বংনিউজ২৪x৭ ডিজিটাল ডেস্কঃ ‘ভালোবাসার বাড়ি’ ছেড়ে চলে গিয়েছেন ‘জীবনপুরের পথিক’। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে প্রায় ১৯ দিনের লড়াইয়ের পর কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার চিরঘুমে চলে গেলেন। যেখান থেকে আর কখনই ফিরবেন না। কেউ ফেরে না।
চলতি বছরের জুন মাসেই কিডনি এবং ফুসফুসের সমস্যা নিয়ে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন বর্ষীয়ান এবং প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র পরিচালক। তারপর থেকেই জারি ছিল লড়াইটা। অবশেষে জীবনযুদ্ধে হার মানলেন তিনি। বিদায় জানালেন ‘চাঁদের বাড়ি’র নির্মাতা। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর, তাঁর অবস্থার অবনতি হওয়ায়, কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁকে উডবার্ন ওয়ার্ড থেকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে তাঁর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু ফের একবার তাঁর অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। রবিবার তাঁকে ভেন্টিলেশনে দিতে হয়। আপ্রাণ চেষ্টা করলেও, সেখান থেকে আর তাঁকে ফেরাতে পারলেন না চিকিৎসকেরা। সোমবার সকাল ১১ টা ১৭ মিনিট নাগাদ মৃত্যু হয় এই কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালকের।
এদিকে, পরিচালকের মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গিকারকে সম্মান জানিয়ে প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদারের দেহদান করা হবে এসএসকেএম হাসপাতালে। পরিচালকের শেষ ইচ্ছে ছিল, মৃত্যুর পর কোনও আড়ম্বর নয়। তাই পরিচালকের ইচ্ছেকে সম্মান জানিয়ে, এসএসকেএম হাসপাতালে হবে দেহদান। সেই প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে বলে সূত্রের খবর।
তাছাড়া মৃত্যুর পর রবীন্দ্রসদন কিংবা নন্দনের কোথাও তার দেহ নিয়ে যাওয়া হোক, তাও চাননি পরিচালক। তাই রাজ্য সরকার চাইলেও, পরিচালকের পরিবারের পক্ষ থেকে সব রকম রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। সেই সঙ্গে জানা গিয়েছে, হাসপাতাল থেকে তাঁর দেহ নিয়ে যাওয়া হবে এনটিওয়ান স্টুডিওতে তাঁর অফিসে। সেখানেই তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন মানুষ। তবে, তরুণ মজুমদারের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী, কোনও ফুল-মালা আনতে বারণ করা হয়েছে তাঁর অনুরাগীদের। এরপরে আবার দেহ ফিরিয়ে আনা হবে হাসপাতালেই।
সপ্তাহের প্রথম দিনে কর্মব্যস্ততার মধ্যেই এই প্রবাদপ্রতিম পরিচালকের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই টলিউডে শোকের ছায়া। শোকপ্রকাশ করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বর্ষীয়ান পরিচালকের মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরই শোকবার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শোকবার্তায় মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, “বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক তরুণ মজুমদারের প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। তিনি আজ কলকাতায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। ভিন্নধারার রুচিসম্মত সামাজিক চলচ্চিত্র নির্মাণে তরুণ মজুমদার উজ্জ্বল নিদর্শন রেখে গিয়েছেন। তাঁর ছবিতে রবীন্দ্রসংগীতের প্রয়োগ দর্শককে আবিষ্ট করে রাখে। তরুণ মজুমদার পরিচালিত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র ‘বালিকা বধূ’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘গণদেবতা’, ‘শহর থেকে দূরে’, ‘পথভোলা’, ‘চাঁদের বাড়ি’, ‘আলো’ ইত্যাদি উল্লেখের দাবী রাখে। তিনি পদ্মশ্রী, জাতীয় পুরস্কার, বিএফজেএ পুরস্কার, ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড-সহ বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। তাঁর প্রয়াণ চলচ্চিত্র জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। আমি তরুণ মজুমদারের পরিবার-পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।” শোকপ্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ও। তিনি টুইট করে তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
এদিন তরুণ মজুমদারের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বলেন, “ভারতীয় চলচ্চিত্রকে অন্য মাত্রা দিয়েছেন তিনি। আমি ওনার সঙ্গে ‘আলো’, ‘চাঁদের বাড়ি’ ছবিতে কাজ করেছি। সম্প্রতি ‘ভালবাসার বাড়ি’তেও কাজ করেছি। ওনার সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি ধন্য। খবরটা শোনার পর থেকেই মনটা অস্থির হয়ে আছে। খুব বড় ক্ষতি হয়ে গেল।”
চোখের জল বাঁধ মানছে না তরুণ মজুমদারের জীবনসঙ্গী তথা বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম কিংবদন্তি অভিনেত্রী সন্ধ্যার। তিনি বলেন, ‘ মানুষটাকে দেখেছি অত্যন্ত কাছ থেকে। আদ্যপান্ত সহজ-সরল একজন মানুষ। কাজের প্রতি এতো নিষ্ঠা, ভালোবাসা আর ক`জনের আছে? কাজ ছাড়া কিছুই চিন্তা করতে দেখিনি কখনও। শুধু কাজ আর একের পর এক শিল্পী তৈরি করা। জীবনের অনেক মুহূর্ত এভাবেই কেটে গিয়েছে। খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ করা কিছুই ছিল না তাঁর জীবনে। শুধু কাজই করে গেলেন সারা জীবন ধরে। বিগত বেশ কিছু বছরে সেই কাজের ঢেউ বদলে গেল। তাই অফার কম পেতেন। আমি আশা করিনি এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবেন। আমি আর কিছুই বলতে পারছি না…উনি আর নেই।’
শোকপ্রকাশ করেছেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ও। ফেসবুকে শোকপ্রকাশ করে তিনি লিখেছেন, ‘হারালাম এক কিংবদন্তি পরিচালককে…হারালাম এক অতুলনীয় মানুষকে…হারালাম আমার শিক্ষককে।’
বাংলা চলচ্চিত্রের এই প্রখ্যাত পরিচালকের জন্ম ব্রিটিশশাসিত ভারতে। তাঁর বাবা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। নাম বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও, চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি তাঁর ঝোঁক তৈরি হয় একসময়। অপর দুই চলচ্চিত্র পরিচালক শচীন মুখোপাধ্যায় এবং দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে জোট বেঁধে ‘যাত্রিক’ নামে চলচ্চিত্র পরিচালনার কাজ শুরু করেন। এই ত্রয়ীর পরিচালনায় প্রথম ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় ‘চাওয়া পাওয়া’ চলচ্চিত্রটি। সেই সুপারহিট চলচ্চিত্রের অভিনয়ে ছিলেন চীরসবুজ জুটি উত্তম-সুচিত্রা। ১৯৬০ সালে বানালেন ‘স্মৃতি টুকু থাক’। এই যাত্রিকের পরিচালনাতেই ১৯৬২ সালে নির্মিত হয় জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘কাঁচের স্বর্গ’। সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন তরুণ মজুমদার, তাই তো বারবার তাঁর সিনেমায় বাস্তব রূপ পেত সাহিত্যকদের লেখা। বনফুল, বিমল কর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকের গল্প নিয়ে ছবি করতেন তিনি। আরও একটা বিশেষত্ব ছিল তাঁর ছবিতে। তাঁর ছবি মানেই রবিঠাকুরের সুর।
তবে, এর কয়েক বছর পরেই ১৯৬৫ সালে ‘যাত্রিক’ থেকে বেরিয়ে আসেন তরুণ মজুমদার। সেই বছরই তিনি আলোর পিপাসা’ এবং ‘একটুকু ভালবাসা’ নামের দু’টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এরপর থেমে থাকেননি। একের পর এক সুপারহিট বাংলা ছবি দর্শককে উপহার দিয়েছেন। সেইসব চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ‘বালিকা বধূ’, ‘কুহেলি’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘আপন আমার আপন’, ‘গণদেবতা’, ‘চাঁদের বাড়ি’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’, ‘আলো’র মতো সিনেমা।
তাপস পাল, মহুয়া রায়চৌধুরী, অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়ের মতো বাংলার তাবড় তাবড় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের প্রথম অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছিলেন তরুণ মজুমদার। তাঁর স্ত্রী সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গেও ২০টি ছবি বানিয়েছেন তিনি। করোনাকালে লকডাউনে পরিচালক তরুণ মজুমদার আবারও বই এবং চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেছিলেন।
নিজের দীর্ঘ কর্মজীবনে একাধিকবার জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেছেন এহেন প্রখ্যাত ও কিংবদন্তি পরিচালক। ১৯৯০ সালে পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মানও। যৌথ পরিবারের আসল অর্থ এবং গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন পরিচালক তরুণ মজুমদার। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের টুকরো টুকরো মুহূর্তগুলোকে চলচ্চিত্রের পর্দায় স্বযত্নে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি বালিকা বধূ’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘আলো’, ‘চাঁদের বাড়ি’র মতো সিনেমার মধ্যে দিয়ে।